বাচ্চা নেওয়ার ডিস্টোপিয়ান ভবিষ্যৎ
বাচ্চা নেওয়ার ক্ষেত্রে বয়স, সমকামিতা কিংবা বাইসেক্সুয়াল হওয়া হয়তো কোনো বাধাই থাকবে না ভবিষ্যতে। সেক্ষেত্রে সামাজিক প্রেক্ষাপট হবে ভয়াবহ।
মানুষ বিয়ে করে মূলত সামাজিকতা আর বংশবিস্তারের যে প্রক্রিয়াটা আছে, সেটা চলমান রাখার জন্য। কিন্তু বর্তমান সমাজে বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে বিয়ে আর বাচ্চা নেওয়ার হার দুটোই কমে যাচ্ছে। এর পেছনে কর্মব্যস্ততা, জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি আর সামাজিক কারণ যেমন আছে, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া বা ইনফার্টিলিটিও একটা বড় কারণ। এগুলো সামাল দেওয়ার জন্য নিত্যনতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনাও থেমে নেই। শারীরিক সম্পর্ক বা বিয়ে ছাড়াই এখন নিজের বাচ্চা নেওয়া সম্ভব। তবে যদি এমন কোনো প্রযুক্তি আসে, যেখানে বিয়ে বা সম্পর্ক তো দূর, এমনকি বিপরীত লিঙ্গের পার্টনার বা ডোনারেরও দরকার পড়বে না, ওই সমাজটা তাহলে কেমন হবে?
শুধু তা-ই নয়, চাইলে চার জন বা তার বেশি মানুষ মিলেও একটা বাচ্চার জন্ম দিতে পারবে! সায়েন্স ফিকশনের গল্প মনে হলেও এগুলো এখন পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে। যদি ফলাফল পক্ষে আসে, আমাদের জীবদ্দশাতেই এসব দেখে ফেলা লাগতে পারে। আর এটা হলে সমকামি গে আর লেসবিয়ান, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার সবাইই বাচ্চা জন্ম দিতে পারবে। এটা নিয়ে আসলেই কাজ হচ্ছে, এবং বড় বড় ব্যবসায়ীরা বস্তা বস্তা টাকা ঢালছে এসব গবেষণায়।
বিষয়টা বুঝতে গেলে আমাদের রিপ্রোডাকশনের বেসিক বায়োলজি বোঝা লাগবে। এসএসসি আর এইচএসসি লেভেলে বায়োলজি থাকলে এগুলো এমনিতেই জানার কথা, তারপরও ধরে নিচ্ছি আপনি এসবের কিছুই জানেন না। একটা বাচ্চা মায়ের পেটে কীভাবে আসে? হাজবেন্ড ওয়াইফের সেক্সের মাধ্যমে একটা স্পার্ম বা শুক্রাণু গিয়ে ওভাম (আসলে ওয়োসাইট) বা ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়, যেটাকে ফার্টিলাইজেশন বলে। ফার্টিলাইজেশনের মাধ্যমে ভ্রুণ তৈরি করে। সেটা ইউটেরাস বা জরায়ুর ভেতর ৪০ সপ্তাহ বা ২৮০ দিনের কমবেশি সময় ধরে ম্যাচুরেশনের মাধ্যমে মানব শিশুর আকার ধারণ করে।
এটা হলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এখন ডিম্বাণু যেখানে তৈরি হয়, সেই ওভারি কিংবা ভ্রুণ যেখানে বড় হয়, সেই ইউটেরাস বা জরায়ুতে বিভিন্ন রোগের কারণে অনেক মহিলার এগুলো কেটে ফেলে দিতে হয়। আবার কারো কারো এগুলো ঠিক থাকলেও প্রজননক্ষম থাকে না।
সেক্ষেত্রে ফার্টিলাইজেশন প্রক্রিয়াটা মহিলার শরীরের বাইরে নিয়ে করে ভ্রুণটা প্রজননক্ষম কোনো মহিলার জরায়ুতে বসিয়ে দিলে সেখান থেকেও বাচ্চা হতে পারে। এটাকে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (In Vitro Fertilization, IVF) বলা হয়। টেস্ট টিউব বেবি বলে যেটা শুনে থাকেন, সেটাই এটা। ১৯৭৮ সালে প্রথম সফল হওয়া এই প্রক্রিয়ায় এখন আমেরিকার ২% বাচ্চা এভাবে জন্ম নেয়। গ্লোবালি এর মার্কেট এখন ২৩ বিলিয়ন ডলার। এখানে যার প্রজননে সমস্যা থাকে, তার লিঙ্গের কোনো ডোনারের কাছ থেকে স্পার্ম বা ওভাম আনা হয়। তারপর সেটা অন্য পার্টনারের স্পার্ম বা ওভামের সাথে ফার্টিলাইজ করে কোনো মহিলার জরায়ুতে স্থাপন করা হয়।
ভিকি ডোনার সিনেমাটা যদি দেখে থাকেন, সেখানে দেখবেন আয়ুশমান খুরানা স্পার্ম ডোনেট করতে থাকে। সেটা ব্যবহার করে এমন কোনো দম্পতি, যাদের পুরুষ পার্টনার হয়তো প্রজননক্ষম না। তখন তার স্পার্ম দিয়ে ফার্টিলাইজ করে বাচ্চা নেয়। আবার উল্টাটাও হয়। এখানে যে মহিলা জরায়ু ভাড়া দিচ্ছে বাচ্চা বড় হওয়ার জন্য তাকে বলা হয় সারোগেট মাদার। এই বাচ্চাদের সারোগেট বেবিও ডাকা হয়। সবসময় যে প্রজননে অক্ষম থাকলেই এভাবে বাচ্চা নেয় এমন নয়। অনেকে বাচ্চা পেটে ধরাকে ঝামেলা মনে করতে পারে, কিংবা এতে চেহারায় যে ভাঁজ পড়ে, সেটা অনেকে এড়াতে চায়। সেক্ষেত্রেও নিজেদের স্পার্ম আর ওভাম দিয়েই জাস্ট আরেকজনের জরায়ু ভাড়া করে বাচ্চা নেয়। শাহরুখ খানের ছোট ছেলেটা এভাবেই জন্মেছে। গে কাপলরাও এভাবে বাচ্চা নেয়। করণ জোহর গে হয়েও এভাবেই বাচ্চা নিয়েছে।
কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন- স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে বাচ্চাগুলো হয়, তা বাবার কাছ থেকে জিনের ৫০% পায়, আর মায়ের জিনের ৫০% পায়। এই কারণে দেখা যায় বাবার বা মায়ের চেহারা কিংবা ব্যবহারে মিল পাওয়া যায়। কিন্তু যদি শুক্রাণু বা ডিম্বাণু অন্যদের থেকে ধার করে আনতে হয়, তাহলে দেখা যায় কেবল ৫০% বাবার বা মায়ের জিন পেয়ে থাকে। বাকি ৫০% আসে ডোনারের কাছ থেকে। তাছাড়া আরেকটা সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, মেয়েদের বয়স ৪৫ বছরের পরে গেলে মেনোপজ হয়ে যাওয়ার কারণে ডিম্বাণু উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
তাছাড়া একটা ২০ থেকে ২৫ বছরের মেয়ের ডিম্বাণুর যে গুণগত মান থাকে, বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সেটার কোয়ালিটিও নিম্নমানের হতে থাকে। এসব সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য যে প্রযুক্তি নিয়ে কাজ চলছে, সেটা হচ্ছে In Vitro Gametogenesis (IVG) বা, শরীরের বাইরে শুক্রাণু আর ডিম্বাণু উৎপাদন করা। এটা করা সম্ভব হলে অন্যের কাছ থেকে আর ধার করে শুক্রাণু ডিম্বাণু আনা লাগবে না। এতক্ষণ এত পাচাল মারার মূল উদ্দেশ্য এই IVG নিয়েই আলাপে আসা। এটা সফল হয়ে গেলে এর সামাজিক প্রভাব হবে ব্যাপক।
২০১২ সালে জন বি গারডন আর শিনিয়া ইমানাকা নামের দুই বিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কার পান Genetic Reprogramming আবিষ্কার করার জন্য। জেনেটিক রিপ্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে কোনো ম্যাচুরড সেল বা পরিপক্ক কোষকে স্টেম সেলে রূপান্তরিত করা সম্ভব। জন গারডন ১৯৬২ সালে ব্যাঙ্গের কোষ থেকে করলেও ২০০৬ সালে ইমানাকা মানুষের চামড়ার কোষ থেকে প্লুরিপটেন্ট স্টেম সেল (Pluripotent Stem Cell) তৈরি করেন। এই স্টেম সেল জিনিসটা অনেকটা কাদা মাটির মতো। আপনি কাদা মাটি দিয়ে মাটির ব্যাংক, পুতুল, এমনকি ঘরও বানাতে পারেন, যদিও আজকাল এসব আর দেখা যায় না। এই স্টেম সেল থেকে রক্তের কোষ, চামড়ার কোষ, মাংসপেশীর কোষ, এমনকি জনন কোষ বা স্পার্ম ওভামও তৈরি করা সম্ভব। শুধু দরকার সঠিক জেনেটিক সিগন্যাল দেওয়া। এই আবিষ্কারটা ছিল হইচই ফেলে দেওয়ার মতোই।
তবে নোবেলজয়ীরা কেবল স্টেম সেল তৈরি পর্যন্তই ছিলেন। পরের স্টেপের কাজটা করেন ২০১৬ সালে জাপানের দুই বিজ্ঞানী ইঁদুরের লেজের চামড়া থেকে কোষ নিয়ে সেখান থেকে স্টেম সেল তৈরি করেন। তারপর ওই স্টেম সেল থেকে কয়েকটা ডিম্বাণু তৈরি করেন। এই ডিম্বাণুগুলো ফার্টিলাইজেশন করে সেখান থেকে দশটা বাচ্চা হয়। এই বাচ্চাগুলোও পরবর্তীতে বংশবিস্তার করে। ২০২৩ সালে এরা আরেকটা মাইলফলক অর্জন করে। এবার একটা পুরুষ ইঁদুরের কোষ থেকে তারা ডিম্বাণু তৈরি করে ফেলে। তারপর আরেকটা পুরুষ ইঁদুরের শুক্রাণু নিয়ে ফার্টিলাইজেশন করে বাচ্চা ইঁদুরের জন্ম নেয়। এটা “Mice with two dads” শিরোনামে সায়েন্টিফিক অঙ্গনে ভাইরাল হয়।
এই IVG প্রক্রিয়াটাই এখন ইঁদুর থেকে মানুষে প্রয়োগের কাজ চলছে। এতে যেকোনো বয়সেই বাচ্চা নেওয়া যাবে। গে বা লেসবিয়ান কাপলরাও বাচ্চা নিতে পারবে, যেখানে নিজেদের জিন থাকবে বাচ্চার মধ্যে। যেমন- একজন গে বা সমকামী পুরুষের কোষ থেকে ‘ডিম্বাণু’ তৈরি করে তার অন্য পুরুষের পার্টনারের শুক্রাণুর সাথে ফার্টিলাইজেশন করে সেটাকে কোনো মহিলার জরায়ু ভাড়া করে বাচ্চা নিতে পারবে। এই বাচ্চার ৫০% করে জিন দুই সমকামী পুরুষেরই হবে। অন্যদিকে সমকামী মহিলাদের ক্ষেত্রে জরায়ু ভাড়া করার বিষয়টিও লাগবে না। কেবল একজন সমকামী মহিলার কোষ থেকে ‘শুক্রাণু’ তৈরি করে অন্যজনের ডিম্বাণুর সাথে মিলিত করে তাদেরই একজনের জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করে দিলেই হবে। তাদের ক্ষেত্রেও ৫০% করে জিন থাকবে বাচ্চার মধ্যে।
তাছাড়া একজন পুরুষ বা স্ত্রীর নিজের কোষ থেকেই বিপরীত লিঙ্গের কোষ উৎপাদনও সম্ভব হওয়ায় চাইলে পার্টনার বা ডোনার ছাড়াই বাচ্চা নেওয়া সম্ভব হবে। যেমন কোনো মেয়ে বিয়ে করতে চায় না, পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্কও রাখতে চায় না। সে চাইলে নিজের কোষ থেকে শুক্রাণু তৈরি করে নিজের ডিম্বাণুর সাথে ফার্টিলাইজ করে নিজের পেটেই বাচ্চা নিতে পারবে। কিন্তু পুরুষ এই কাজটা করতে গেলে কোনো মহিলার জরায়ু ভাড়া নিতেই হবে। বর্তমানে অবশ্য কৃত্রিম জরায়ু নিয়েও কাজ চলছে। সেটাও এসে গেলে জরায়ু ভাড়া নেওয়ার প্রয়োজনও পড়বে না। এক্ষেত্রে বাচ্চার জিনের ১০০%-ই হবে তার নিজের। এক্ষেত্রে বাচ্চার জন্ম দেওয়া ব্যক্তি আদৌ বাবা কিংবা মা হবে, নাকি দেরিতে জন্ম নেওয়া Twin হবে, সেটা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে।
আবার এর উল্টাটাও সম্ভব হবে এই প্রযুক্তিতে। বর্তমানে অনেক কাপলই আছে, যাদের একজন বাইসেক্সুয়াল। কিংবা এমনও আছে যারা মাল্টিপল পার্টনার নিয়ে একসাথেই থাকে। তাদের ক্ষেত্রেও একত্রে বাচ্চা নেওয়া সম্ভব হবে। যেমন- ৪ জনের একটা বাচ্চা নেওয়া সম্ভব হবে, যেখানে প্রত্যেকের ২৫% করে জিন বাচ্চার মধ্যে থাকবে।
এই পর্যন্ত পড়ে থাকলে যদি সায়েন্স ফিকশনের আকাশ কুসুম চিন্তা মনে হয়, তাহলে একটু খোঁজখবর নিয়ে দেখুন এগুলোর পেছনে মিলিয়ন ডলার ঢালা হচ্ছে। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত Conception নামে একটা কোম্পানি এটা নিয়ে কাজ করছে। এতে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে আসা বিজ্ঞানীরা কাজ করছে। এই কোম্পানিটা শুধু যে ব্যবসায়িক দিক চিন্তা করেই এটা নিয়ে কাজ করছে এমন নয়। এর প্রতিষ্ঠাতা কিংবা বিনিয়োগকারীদের ব্যক্তিগত ইন্টারেস্টও আছে এখানে।
Conception এর প্রতিষ্ঠাতাদের মাঝে ম্যাট ক্রিসিলফ (Matt Krisiloff) আর পাবলো হুরতাদো গুঞ্জালেস দুইজনই গে (যদিও তারা পার্টনার না)। হুরতাদো সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের হলেও ক্রিসিলফ এমন কেউ না। একসময় Y Combinator এ কাজ করত, যেটা বিভিন্ন স্টার্টআপ কোম্পানিকে ফান্ড দেওয়া থেকে পরামর্শ দেওয়ার কাজ করে থাকে। Airbnb, Dropbox, Reddit এর মতো কোম্পানিগুলো Y Combinator থেকেই আসা। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই Y Combinator এর প্রেসিডেন্ট ছিল স্যাম অল্টম্যান। এরপর সে পুরোপুরি Open AI নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, যারই প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে আমরা ChatGPT দেখতে পাই।

এই স্যাম অল্টম্যানের সাথে একসময় প্রেম করত ম্যাট ক্রিসিলফ। অল্টম্যান তার Hydrazine Capital এর মাধ্যমেই Conception এ বিনিয়োগ করে। অর্থাৎ, শুরুর বিনিয়োগটা আসে অল্টম্যান থেকে। এখন অবশ্য আরো বিনিয়োগকারী আছে, যার মধ্যে স্কাইপের প্রতিষ্ঠাতাও আছে। স্যাম অল্টম্যানের সাথে এখন আর প্রেমও নেই। অল্টম্যান গত বছর আরেকটা ছেলেকে বিয়ে করেছে। ক্রিসিলফও এখন আরেক ছেলের সাথে প্রেম করে। আবার এদের সবার গুরু হচ্ছে পেপালের প্রতিষ্ঠাতা সিলিকন ভ্যালির অন্যতম প্রভাবশালী লোক পিটার থিয়েল।
অল্টম্যান যে Hydrazine Capital থেকে Conception এ বিনিয়োগ করেছে, এটা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল পিটার থিয়েল। আবার ২০১৫-১৭ এর সময়টায় Y Combinator এর একজন উপদেষ্টাও ছিল থিয়েল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেনশিয়াল ক্যাম্পেইনেও খরচ করেছে থিয়েল। এই পিটার থিয়েলও কিন্তু গে। ক্রিসিলফ আর হুরতাদো দুজনই তাদের কাজের মোটিভেশনের পেছনে বলেছে, গেরাও যাতে এমন বাচ্চা নিতে পারে, যেখানে তাদের নিজেদের জিন থাকবে।
IVG এর সাথে আরেকটা টেকনোলজি কাজ করবে, সেটা হচ্ছে CRISPR (ক্রিস্পার)। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের শরীরের জিন এডিট করা যায়। আপনার যদি কোনো জেনেটিক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী জিন এডিট করে রোগ থেকে নিরাময় করা সম্ভব হবে। ২০২০ সালে এই ক্রিস্পার প্রযুক্তির জন্য নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়। IVG এখনো মানুষের ক্ষেত্রে সম্ভব না হলেও CRISPR দিয়ে ইতোমধ্যে চাইনিজরা ‘ডিজাইনার বেবি’ বানিয়ে ফেলেছে। ডিজাইনার বেবি বলতে আপনি IVG এর মাধ্যমে এমন কয়েকটা ভ্রুণ বানাতে পারেন, যেখানে বাচ্চার ফর্সা হওয়া, আইকিউ বেশি থাকা, লম্বা হওয়া, জেনেটিক রোগ না থাকা এমন অর্ডার করা বাচ্চা নিতে পারবেন। এতে বাচ্চা হয়ে যাবে একটা পণ্যের মতো। ডিজাইনার বেবি নিয়ে চাইলে আলাদা লেখা যাবে আরো, বড় হয়ে যাবে দেখে এখন আর বেশি বললাম না।
এই ডিস্টোপিয়ান আইডিয়াগুলো বাস্তবায়ন হওয়া এখনো অনেক দূরের পথ। এগুলো সম্ভব না-ও হতে পারে। সেটা কথা না। এসব চিন্তা করার প্রয়োজনটা কী? কোনো প্রযুক্তি দিয়ে কিছু করার সম্ভাবনা থাকলেই প্রয়োগ করা লাগবে? পারমাণবিক বোমা দিয়ে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব হলেও তো যুদ্ধক্ষেত্রে এর ব্যবহার হচ্ছে না। তাহলে এর দরকারটা কী?
কারা এসব প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করছে, তাদের দেখলেই অবশ্য বোঝা যায় তারা কী চায়। এরকম বাস্তবতায় সমাজ কাঠামোটা কেমন হবে? যাদের ছোট বাচ্চা আছে, তারা হয়তো দেখেছেন বাচ্চা প্রথমেই ‘মা’ কিংবা ‘বাবা’ ডাকা শিখছে। এরকম হলে বাবা মা বলে কিছু কি আর থাকবে? এই শব্দগুলোই তো তখন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে।
এই প্রযুক্তি সফল হলে চিরায়ত পরিবার বলে কিছু আর অবশিষ্ট থাকবে না। সমকামীদের সংখ্যা আরো বাড়বে। সেটাই হয়তো তখন নরমাল হিসাবে দেখা হবে। ফার লেফট মিডিয়া প্রোপাগান্ডা মেয়েদের আরো ব্রেনওয়াশ করবে। তারা বলবে পুরুষ খারাপ, তোমার বাচ্চা নেওয়ার জন্যও পুরুষের কোনো প্রয়োজন নেই। এটা বলে পকেট থেকে লাখ লাখ ডলার নিয়ে নিবে।
এই প্রযুক্তি কেবল ধনীদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই থাকবে। Conception যেমন বলছে, তাদের সেবা নিতে গেলে দুই লাখ ডলার খরচ পড়তে পারে। এর সাথে যদি জিন এডিটিংও যোগ হয়, আরো লাখখানেক ডলার হয়তো বাড়বে। এতে বাচ্চাগুলো হবে, তারা হয়তো স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া বাচ্চাদের তুলনায় বেশি কর্মক্ষম, মেধাবি, কিংবা সৌন্দর্যের অধিকারী হবে। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া বাচ্চা শ্রেণিদের ইনফিরিয়র হিসাবে দেখা হতে পারে।
একদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অন্যদিকে মানুষের শরীরের সবকিছুই যদি কৃত্রিম হওয়া শুরু করে, এমনকি সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চাটাও যদি কৃত্রিমভাবে জন্ম নেওয়া শুরু করে, তাহলে অর্গানিক বলে থাকবেটা কী? তাছাড়া এসব বাচ্চা যদি চাহিদামাফিক পারফরম্যান্স দেখাতে না পারে, তাদের ওপর বাবামায়ের (যদি আদৌ এমন কেউ থাকে) কেমন প্রতিক্রিয়া আসবে? কোনো সেলিব্রেটিকে ফাঁসানোর জন্য তার নমুনা কোষ জোগার করে অন্য কারো কোষের সাথে মিলিয়ে যদি বাচ্চা উৎপাদন করা হয়, সেক্ষেত্রে কী একশন নেওয়া হবে?
শারীরিক বা মেডিকেল কমপ্লিকেশন কী হতে পারে, সেই দিকে না-ই গেলাম। সামাজিক প্রেক্ষাপট চিন্তা করতেই তো ভয় লাগছে। হয়তো আইন হবে, অনেক নিয়ম কানুন আরোপ হবে। কিন্তু আবারো একই প্রশ্ন। প্রযুক্তির সম্ভাবনা থাকলেই কেন প্রয়োগ করতে নামা লাগবে?
অবশ্য এগুলো সবই নির্ভর করছে ধনী ব্যক্তিদের মর্জির ওপর। তারা চাইলে আমাদের সেখানে আর কতটুকোই বা বলার অধিকার আছে? ওরা মিডিয়া আর মাস ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে নিজেদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করে ফেলে। যেমন- Conception বা এই ইন্ডাস্ট্রির অন্য কোম্পানিগুলো বলছে, এসব পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য তাদের হয়ে অনেক ভলান্টিয়ার কাজ করছে। অর্থাৎ, নিজেদের কোষের নমুনা কিংবা জরায়ু ভাড়া দেওয়ার মতো মানুষের অভাব নেই তাদের কাছে। এসব চিন্তা করলে আমরা হয়তো একটা ডিস্টোপিয়ার দিকে যাচ্ছি, যেখানে মানুষ বলতে যা বুঝি, সেটাই হয়তো আর থাকবে না।
বিস্তারিত আরো পড়াশোনা করতে চাইলে: